• July 13, 2025
  • 30 Degree
  • INDIA
NPE 2020

“শিক্ষার মাঠে রাজনীতির যুদ্ধ: NEP 2020 ও বাংলার স্বায়ত্তশাসনের লড়াই”

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষানীতি বিতর্ক: স্বায়ত্তশাসন, অর্থবরাদ্দ ও NEP 2020-কে ঘিরে সংঘাত

পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে শিক্ষানীতি নিয়ে চলমান দ্বন্দ্ব এখন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, অর্থবরাদ্দ ও মতাদর্শগত পার্থক্যের বৃহত্তর বিতর্কে রূপ নিয়েছে। এই সংঘাতের মূল কেন্দ্রে রয়েছে রাজ্যের জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP) 2020 প্রত্যাখ্যান এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রী স্কুল (PM SHRI) প্রকল্পে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত। রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্রের শর্তযুক্ত অর্থায়ন এবং রাজ্য স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপই এই সিদ্ধান্তের কারণ।

NEP 2020 প্রত্যাখ্যান ও রাজ্যের নিজস্ব নীতি

কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান উদ্যোগ জাতীয় শিক্ষানীতি 2020-এর লক্ষ্য নমনীয় পাঠ্যক্রম, বহুশাস্ত্রীয় শিক্ষা ও প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে রূপান্তরিত করা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস এই নীতিকে “বিভেদমূলক” ও “কেন্দ্রীকরণের চেষ্টা” বলে আখ্যা দিয়েছে। এর বিপরীতে, ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ নিজস্ব রাজ্য শিক্ষানীতি চালু করে, যেখানে স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও বাংলা পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া NEP-এর তিন ভাষার সূত্রকেও বাতিল করা হয়েছে, যা বাংলা ভাষাকে প্রান্তিক করতে পারে বলে রাজ্য সরকার মনে করে।

সমালোচকদের মতে, তৃণমূলের এই অবস্থান রাজনৈতিক। তবে রাজ্য কর্মকর্তাদের যুক্তি, গ্রামীণ স্কুলে উচ্চ ড্রপআউটের হার, অবকাঠামোর অভাবসহ বাংলার নিজস্ব চাহিদা মেটাতেই এই নীতি প্রণয়ন।

PM SHRI প্রকল্প ও অর্থবরাদ্দের দ্বন্দ্ব

PM SHRI প্রকল্পে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত সংঘাতকে আরও তীব্র করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৪,৫০০টির বেশি স্কুলে আধুনিক অবকাঠামো, স্মার্ট ক্লাসরুম ও ক্যারিয়ার পরামর্শ পরিষেবা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পে যুক্ত হতে গেলে NEP 2020 বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক—এমন শর্তকে পশ্চিমবঙ্গ “জবরদস্তি” বলে উড়িয়ে দেয়।

রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অভিযোগ করেন, “শিক্ষাকে রাজনৈতিক সমর্পণের হাতিয়ার বানানো হচ্ছে।” এই প্রকল্প থেকে দূরে থাকায় রাজ্য হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য তহবিল হারানোর ঝুঁকিতে আছে, যা রাজ্যের ৫০,০০০-এর বেশি সরকারি স্কুলের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বনাম কেন্দ্রীয়করণ

এই দ্বন্দ্ব শিক্ষাক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বৃহত্তর টানাপোড়েনের প্রতিফলন। কেন্দ্রের যুক্তি, NEP 2020 ও PM SHRI জাতীয় স্তরে শিক্ষার মান নিশ্চিত করবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ একে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর হামলা বলে মনে করে। তৃণমূল নেতাদের মতে, “শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয় হলেও কেন্দ্র রাজ্যের সাথে আলোচনা ছাড়াই নীতি চাপিয়ে দিচ্ছে।”

কেরল, তামিলনাড়ুর মতো অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিও NEP-এর বিরোধিতা করলেও পশ্চিমবঙ্গের আগ্রাসী অবস্থান আলাদা। এটি রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রবণতা বাড়াচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জনগণের প্রভাব

এই সংঘাত বিজেপি-তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাথে গভীরভাবে জড়িত। বাংলায় বিজেপির প্রভাব বাড়তে থাকায় তৃণমূল রাজ্য স্বায়ত্তশাসন রক্ষাকে নিজের পরিচয়ের অঙ্গ করে তুলেছে। অন্যদিকে, কেন্দ্রের দাবি, NEP ও PM SHRI প্রত্যাখ্যানের ফলে রাজ্যের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে।

মাঠপর্যায়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ স্থানীয় চাহিদা মেটানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও অন্যরা জাতীয় স্তরের সাথে অসামঞ্জস্যতার শঙ্কা প্রকাশ করেন। কলকাতার এক শিক্ষকের কথায়, “চাকরি বা জাতীয় পরীক্ষায় প্রতিযোগিতায় আমাদের শিশুরা পিছিয়ে পড়তে পারে।”

সামনের পথ

এই অচলাবস্থার মূল্য দিতে হতে পারে শিক্ষার্থীদের। রাজ্য সরকার নিজস্ব তহবিলে স্কুল আধুনিকীকরণের ঘোষণা দিলেও আর্থিক সীমাবদ্ধতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, কেন্দ্র NEP-এর শর্ত শিথিল করতে নারাজ।

এই সংকট ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে: জাতীয় মান ও আঞ্চলিক স্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় সম্ভব? নাকি শিক্ষাই থেকে যাবে রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাঠ? এখনও পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গের শ্রেণিকক্ষই এই টানাপোড়েনের বলি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *